প্রতিপক্ষের সঙ্গে মাঠে লড়াই করলেই চলত। কিন্তু মনীষা আক্তারের লড়াইটা মাঠের বাইরেও। তির-ধনুক কেনার সামর্থ্য নেই। অন্যের ব্যবহৃত পুরোনো ধনুক নিয়ে খেলছেন। ধার করা ধনুকের তিরগুলোও গোঁজামিলের। গতকাল টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামে শেষ হওয়া জাতীয় যুব আর্চারিতে রিকার্ভ ইভেন্টে খেলেছেন কম্পাউন্ডের ভেঞ্চ (তিরের পেছনে গতিবাড়ানো পালক) দিয়ে। সব বাধা পেরিয়ে অবশেষে পদকমঞ্চে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন ঢাকা মেরিনার ইয়াংস ক্লাবের তরুণ এই আর্চার।
এটি ছিল তাঁর প্রথম জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা। রিকার্ভের মেয়েদের এককে জুনিয়র বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালে হারিয়েছেন বিকেএসপির উর্নিশা মারমাকে, সেমিফাইনালে বিকেএসপির ফারজানা নুসরাতকে। সোনার লড়াইয়ে কাল হেরেছেন দেশসেরা আর্চার দিয়া সিদ্দিকীর কাছে।
প্রতিবেশীদের নেতিবাচক কথাবার্তার কারণে বাবা–মা চাইতেন না মেয়ে খেলায় আসুক। পেছন ফিরে বলেন মনীষা, প্রতিবেশীরা বলত, মেয়ে মানুষের আবার কিসের খেলা? বাবাকে বলত, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও। ট্রাউজার, ট্র্যাকসুট পরে অনুশীলনে যেতাম বলে নানা রকমের খারাপ মন্তব্য করত পড়শিরা। এ জন্য বাবা ঢাকায় খেলতে পাঠাতে চাননি। শেষে পাশে দাঁড়ান আর্চারি কোচ সাইফুদ্দিন বাচ্চু। তাঁর অনুপ্রেরণায় খেলায় আসেন রাজশাহী মাদার বখ্শ্ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী মনীষা। কাল পদক জয়ের পর সেই কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন ২০ বছর বয়সী তরুণী, ২০১৮ সালে রাজশাহীতে আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প হয়েছিল। ৮০ জন মেয়ের মধ্যে ১০ জনকে বাছাই করে ফেডারেশন। ওই বাছাইয়ে প্রথম হয়ে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাকও পেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা-মা কিছুতেই ঢাকায় খেলতে দিতে রাজি হচ্ছিল না।
কিন্তু প্রতিভার অবমূল্যায়ন দেখতে রাজি ছিলেন না কোচ সাইফুদ্দিন। শেষ পর্যন্ত মনীষার বাবাকে রাজি করিয়ে খেলার অনুমতি নেন কোচ। শুরুতেই মনীষা ডাক পান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও তিরন্দাজ সংসদ ক্লাব থেকে। কিন্তু ভালো সুযোগ–সুবিধা ও সরকারি চাকরির আশায় ২০১৮ সালে সেনাবাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে যোগ দেন।
সেনাবাহিনী দলে খেলার সুযোগ না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত এবার নাম লেখান মেরিনার ইয়াংস ক্লাবে। এই ক্লাবের একমাত্র আর্চার হিসেবে মনীষা এবার খেলেন জাতীয় যুব চ্যাম্পিয়নশিপে। প্রথমবার খেলতে নেমেই পদক জয়। অথচ নিজেকে প্রমাণের সুযোগটা কখনো পাননি। এবার সেই সুযোগ পেয়ে মনীষা বলছিলেন, আমার ভেতরে প্রচণ্ড জেদ কাজ করছিল। নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ না পাওয়ায় কষ্ট পেতাম। এবার সুযোগ পেয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছি, আমিও পারি।
মনীষার বাবা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মশকনিধন কর্মী। ফগার মেশিন দিয়ে মশার ওষুধ ছেটান। বাবার চাকরিটা অস্থায়ী। আর্চারি খেলে পরিবারের দুঃখ ঘোচাতে চান মনীষা, আশায় ছিলাম সেনাবাহিনীতে খেলে পদক জিতব। তাহলে হয়তো চাকরিটা স্থায়ী হতো। কিন্তু সেই সুযোগ পাইনি। তবে এবার ক্লাবের হয়ে ভালো খেলেছি। পুলিশ ক্লাব আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আশা করি সেখানে চাকরি হয়ে যাবে।
মনীষাকে সেনাবাহিনীতে খেলার সুযোগ করে দেন আর্চারি কোচ সাজ্জাদ হোসেন। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজাহ আর্চারি দলের কোচ সাজ্জাদ হোসেন টেলিফোনে বলছিলেন, ওর শুটিং, উচ্চতা (৫ ফুট ৩ ইঞ্চি) দেখে ভালো লেগেছিল আমার। ফেডারেশনের ট্রায়ালে ভালো করায় সেনাবাহিনীর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায়। সম্ভাবনাময় আর্চার সে। ভালো সুযোগ–সুবিধা পেলে আরও উন্নতি করবে।
নিজের প্রিয় আর্চার দিয়া সিদ্দিকীর মতো অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন দেখেন মনীষা, প্রথমবার জাতীয় যুব আর্চারিতে খেলতে নেমেই পদক জিতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেছে আমার। কোচ (মার্টিন ফ্রেডরিখ) নিশ্চয় আমার খেলা দেখেছেন। দিয়ার মতো আগামীতে অলিম্পিকে খেলতে চাই।