আর্লিং হলান্ডের দুর্বলতা খুঁজছেন? পাচ্ছেন না তো! ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ১২ ম্যাচে ১৯ গোল, সতীর্থদের তিনটি গোলে সহায়তা। সিটির হয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে খেলতে শুরু করার ২ মাসের মধ্যেই ছোট-বড় মিলিয়ে গোটা দশেক রেকর্ডও ভেঙেছেন। প্রতিপক্ষ গোলরক্ষক তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ‘অতিমানব’ বলে। এমন একজন খেলোয়াড়ের দুর্বলতা খুঁজে বের করার কাজটা কঠিনই বটে!
কিন্তু হলান্ডকে যতটা নিখুঁত মনে হচ্ছে, আসলেই কি তিনি ততটা নিখুঁত? হলান্ডকে নিয়ে এক নিবন্ধে ক্রীড়া লেখক ক্রিস সটন কদিন আগে লিখেছেন, হলান্ডকে কোনো পাগলা বিজ্ঞানীর পরীক্ষাগারে তৈরির যে ধারণা, সেটা তাঁর পছন্দ হয়েছে। সেই ধারণা বেশ আগ্রহ জাগানিয়া।
বিভিন্ন ফুটবল–পণ্ডিত আর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম তো হলান্ডকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত। হলান্ডকে নিয়ে এমন একটা ধারণাও এরই মধ্যে প্রচলিত হয়ে গেছে—তাঁর বাঁ পা ফেরেঙ্ক পুসকাসের, শক্তি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর, গতি গ্যারেথ বেলের, অভিনবত্ব জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচের আর মানসিক শক্তি অ্যালান শিয়ারারের।
সব মিলিয়ে হলান্ড একের ভেতর অনেকের সম্মিলন! আসলেই কি তা-ই, নাকি এটা বাড়াবাড়ি? এখনই কিছু বলা কঠিন। পরিসংখ্যানকে সত্যি ধরে নিলে এ মাতামাতিকে বাড়াবাড়ি বলার সুযোগ কম। তবু হলান্ড যে ল্যাবে তৈরি কোনো নিখুঁত খেলোয়াড় নন, বিশ্লেষকের মন নিয়ে টেলিভিশনের সামনে খেলা দেখতে বসা যেকোনো ফুটবলবুভুক্ষুই হয়তো বুঝতে পারবেন!
হলান্ড এ মুহূর্তে নিজের সেরা ছন্দে আছেন। সবকিছুই হচ্ছে তাঁর পায়ের মাপে! নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার এমন ছন্দে আছেন যে কখনো কখনো মনে হতে পারে, তাঁর পা যেন ভুল করতেই ভুলে গেছে। নিজের এমন ছন্দ দেখে হলান্ড নিজেও যেন একটু বিস্মিত! এই তো কদিন আগেই বলেছেন—এতটা তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি!
তা হলান্ড সেভাবে ভাবতে পারুন আর না–ই পারুন, অনেক গ্রেটের সঙ্গে তাঁর তুলনা শুরু হয়ে গেছে ফুটবল বিশ্বে।
এই যেমন হলান্ডকে বলা হচ্ছে মেসি-রোনালদোর উত্তরসূরি। কেউ আবার কিলিয়ান এমবাপ্পে আর তাঁর মধ্যেই দেখতে পাচ্ছেন ফুটবলের ভবিষ্যৎ দ্বৈরথ। প্রথমেই আসা যাক মেসি-রোনালদোর সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গে। হলান্ডের গোল স্কোরিং ক্ষমতা অবিশ্বাস্য।
বলসহ এবং বল ছাড়া জায়গা বের করার সামর্থ্যও ঈর্ষণীয়। ডি-বক্সের ভেতর হলান্ডের পায়ে বল মানে আরেকটা গোলের সম্ভাবনা। কখনো কখনো করছেন চোখ ধাঁধানো গোলও। প্রিমিয়ার লিগে এখন পর্যন্ত ১৯১ বার বল স্পর্শ করে গোল করেছেন ১৪টি। অর্থাৎ প্রতি ১৩.৬ বার বল স্পর্শে করে ১টি করে গোল করেছেন হলান্ড।
হলান্ডের বয়স এখন ২২ বছর। পরিসংখ্যানবিদেরা এ বয়সে মেসি, রোনালদো ও এমবাপ্পের তুলনায় হলান্ড কতটা এগিয়ে, সেই হিসাব এরই মধ্যে বের করে ফেলেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪ ম্যাচে ০.৮ গড়ে হলান্ডের গোল ১৫৪টি। আর এই বয়সে এমবাপ্পে ২০২ ম্যাচে ০.৬৫ গড়ে করেছেন ১৩১ গোল। ১৬২ ম্যাচে ০.৫ গড়ে মেসির গোল ছিল ৮০ এবং ২১৪ ম্যাচে ০.২৫ গড়ে রোনালদোর গোল ৫৩টি।
পরিসংখ্যানের মায়াবি বিভ্রম থেকে বেরিয়ে এবার যদি বাস্তবের মাটিতে পা রাখা যায়, তাহলে কী দেখবেন? সোনার মাঝেও খাদ আছে! আর এ বাস্তবতাই মনে করিয়ে দেয়, একটু ওপরেই যে পরিসংখ্যানটা দেওয়া হলো, সেটার একটা পাদটীকা বাঞ্ছনীয়—মাঠে অবস্থান আর মূলত গোল করার ভূমিকাতেই খেলার কারণেই এ পরিসংখ্যানে হলান্ড বাকিদের চেয়ে এগিয়ে।
গোল করা, গোল করানো, ড্রিবল, খেলা তৈরি করা—মাঠে মেসি, রোনালদো, নেইমারদের এমন ভূমিকাতেই দেখা যায়। এমবাপ্পে সেভাবে প্লে–মেকারের ভূমিকা না নিলেও ম্যাচে বলে প্রচুর স্পর্শ থাকে তাঁর। এ ছাড়া ড্রিবলও করেন প্রচুর। অন্যদিকে অ্যাটাকিং থার্ডের নিচে হলান্ডকে খুব একটা দেখা যায় না বললেই চলে। হলান্ড নিচে নেমে খেলা তৈরি করেছেন কিংবা ড্রিবল করে গোল পেয়েছেন, এমন দৃশ্যও বিরল।
যদিও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে ফিল ফোডেনকে দেওয়া তাঁর দ্বিতীয় পাসটা নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। তবে ব্যতিক্রম তো আর উদাহরণ নয়। বক্সের আশপাশে ছাড়া বা গোল করার জন্য পা লাগানো বাদে বল স্পর্শেও যেন তীব্র অনিহা হলান্ডের! এ নিয়ে সরাসরিই বিরক্তি দেখিয়েছেন ম্যান সিটির কোচ পেপ গার্দিওলাও। এরপর অবশ্য ইউনাইটেড ম্যাচে বল স্পর্শের সংখ্যা বেড়েছে। সেই ম্যাচে সর্বোচ্চ ৩৫ বার বল স্পর্শ করেছেন হলান্ড।
তবু মেসি-রোনালদোর সঙ্গে হলান্ডের তুলনা এখনো দূরের বাতিঘর। খেলোয়াড় হিসেবে তিনজনই আলাদা এবং শক্তির জায়গাও আলাদা। গার্দিওলা যেমনটা বলেছেন, ‘হলান্ড যা করছে, তা করতে তার সব সতীর্থকে প্রয়োজন হয়, আর মেসি নিজেই সব করতে পারে।’ রোনালদোর ক্ষেত্রেও অনায়াসে একই কথা বলে দেওয়া যায়। নিজের সেরা সময়ে কত শতবার যে একাই ম্যাচের গতিপথ বদলে দিয়েছেন রোনালদো! অন্যদিকে হলান্ডের কারিকুরির সবই এখনো ডি-বক্সের আশপাশেই সীমাবদ্ধ।
লং বল রিসিভ করার ক্ষেত্রেও অনেক সময় দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেখান হলান্ড। নরওয়েজিয়ান স্ট্রাইকার ‘দানব’ হয়ে ওঠেন ডি-বক্সের মধ্যে বল পেলে। প্রিমিয়ার লিগে তাঁর ১৪ গোলের ৮টিই ছয় গজের মধ্য থেকে। বাকি ৬ গোল এসেছে ৬ থেকে ১৮ গজের মধ্যে। ডি-বক্সে তাঁকে আটকাতেই হিমশিম খাচ্ছে ডিফেন্ডাররা। তবে আধুনিক ফুটবলে কারও কোনো দুর্বলতাই বেশি দিন অনাবিষ্কৃত থাকার কথা নয়। এরই মধ্যে হয়তো হলান্ড-ফর্মুলা ডি-কোডিং করতে শুরু করেছে প্রতিপক্ষ দলগুলো।
গায়ে লেগে হলান্ডকে পাহারা দেওয়ার বদলে একটু দূর থেকে কাজটা করে ফল পাওয়ার কথা বলছেন অনেক বিশ্লেষক। আর খেলা বানানোয় তিনি উন্নতির চেষ্টা করছেন। গার্দিওলাও চেষ্টা করছেন তাঁকে নিয়ে। তবে মেসি-রোনালদো-নেইমারের মতো এ জায়গায় তাঁর প্রতিভা সহজাত নয়। তাই এ জায়গায় অভূতপূর্ব উন্নতি দেখার সম্ভাবনাও কম।
যদিও হলান্ড বলেছেন, তিনি দ্রুত মানিয়ে নিতে পারেন, নিচ্ছেনও। তবে তা যথেষ্ট কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়। নিয়মিত গোল করায় সেসব ঘাটতি হয়তো এখনই চোখে পড়ছে না। তবে গোলের ধারা কমে এলে, এ দিক নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জেই পড়তে হতে পারে হলান্ডকে।
হলান্ডের সঙ্গে কিলিয়ান এমবাপ্পেরও বেশ তুলনা হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই দুজনের দ্বৈরথ নিয়েও রোমাঞ্চিত ফুটবলপ্রেমীরা। তবে এমবাপ্পে কিংবা নেইমারের খেলা তৈরি করার যে দক্ষতা, তা হলান্ডের নেই। হ্যাঁ, সুযোগগুলোকে গোলে রূপান্তরের হার কিংবা ডি–বক্সে ক্ষিপ্রতায় হলান্ড এগিয়ে থাকলেও থাকতে পারেন অথবা পরিসংখ্যান বলছে, তিনি এগিয়েই আছেন; তবে এখনো তাঁদের মতো পরিপূর্ণ বা নিখুঁত হলান্ড নন। এ জায়গাগুলোতে নিজেকে বিকশিত করতে না পারলে সামনের দিনগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিই হতে হবে তাঁকে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে পারে চোট। হলান্ডের উচ্চতা ও লম্বা পা তাঁর জন্য আশীর্বাদ হলেও কখনো তা সমস্যাও হয়ে দাঁড়াতে পারে। মারাত্মক কোনো ট্যাকলে চোটে পড়লে ফিরে এসে এই ক্ষিপ্রতা থাকে কি না, এই প্রশ্ন থাকছেই।
ভার্জিল ফন ডাইকের ক্ষেত্রেই যেমন দেখা গেছে, চোট থেকে সেরে উঠে নিজেকে তিনি হারিয়ে খুঁজেছেন। চোটে পড়ার আগের ফন ডাইক আর চোট থেকে ফেরার পরের ফন ডাইকের পার্থক্য দেখতে বিশ্লেষকের চোখ থাকার প্রয়োজন নেই। হলান্ডের চোটে পড়ার প্রবণতা আগে থেকেই আছে। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের মতো শরীরনির্ভর ফুটবলের একটি জায়গায় নিজেকে চোট থেকে বাঁচিয়ে রাখাও হলান্ডের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ।
সব মিলিয়ে হলান্ডের মেসি-নেইমার-রোনালদো হওয়ার পথে অনেক বাধা। সেই সব বাধা পেরিয়ে তিনি কি পারবেন নিজেকে ওই উচ্চতায় নিয়ে যেতে? সময়ই দেবে এর উত্তর।