বাড়ি তাঁর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের ভোটমারী ইউনিয়নের শৌলমারী গ্রামে। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। ১৯৬৯ সালে কালীগঞ্জের হাজরানিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। অভাবের কারণে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।
মানুষের জমিতে কাজ করে টাকা-পয়সা জমিয়ে পড়তেন।
মোসলেম উদ্দিনের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। চরে সে সময় উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। তা ছাড়া অভাব তো পিছু ছাড়েনি।
ফলে সন্তানদেরও বেশিদূর পড়াতে পারেননি। ‘মুই (আমি) যখন স্কুলে যাং (যাই), তখন শৌলমারী চরৎ আর কোনো স্কুল আছিল নাহ। বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটি ছয় কিলোমিটার দূরে যায়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি আসছিনুং। সংসারে অভাবও আছিল সেই সময়।লেখাপড়া ওই পর্যন্ত।’ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন মোসলেম।
তিস্তার এই দুর্গম চরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ত। মোসলেম মাঠে কাজ করতেন আর সন্ধ্যায় শিশু-কিশোরদের অক্ষরজ্ঞান শেখাতেন। পাড়ার ঘরে ঘরে খোঁজ নিতেন।
কিশোরদের দেখলেই পড়তে যেতে বলতেন। কাউকে কাউকে কানমলা দিয়ে বলতেন, ‘কাল থেকে স্কুলে যাবি। পড়তি আসবি।’ তবে গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাইমারির পর ছেলেমেয়েদের তেমন জোর দেওয়া যেত না। মোসলেম স্বপ্ন দেখতেন, গ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় হবে। ছেলেমেয়েরা আর ঝরে পড়বে না। কিন্তু তাঁর নিজের তো স্কুল করার মতো সামর্থ্য নেই।
শুরুর দিকে খুব উৎসাহের সঙ্গে চললেও ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টিতে লেখাপড়ার মান নিম্নগামী হতে শুরু করে। মোসলেম একদিন স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। সপ্তম শ্রেণিতে গিয়ে দেখলেন, শিক্ষার্থীরা গল্প করছেন। জানলেন, ইংরেজি স্যার আসেননি। তিনি প্রায়ই আসেন না। শিক্ষার্থীদের জন্য মোসলেমের মায়া লাগে। তিনি বই নিয়ে পড়াতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা খুশি হয়। পরদিনও মোসলেম স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিলেন। তাঁর পাঠদানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সেই থেকে এভাবে টানা ১৫ বছর ইংরেজি পড়াচ্ছেন তিনি। বিনা বেতনে। ‘মুই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করি পড়াং। বেতন-ভাতার কথা চিন্তা করি না। ছওয়াগুলে আমাক দাদু কয়া ডাকায়। এতে মুই মেলা আনন্দ পাই।’ বললেন মোসলেম।